সম্প্রতি
অবসর নেওয়া বিশ্বের অন্যতম সেরা মিডফিল্ডার ডেভিড বেকহামের জন্ম ১৯৭৫ সালের ২ মে লন্ডনে।
ইংল্যান্ড জাতীয় ফুটবল দলের হয়ে ১১৫টি আন্তর্জাতিক ম্যাচের মধ্যে অধিনায়ক হিসেবেই
খেলেছেন ৫৮টি। দীর্ঘ ২০ বছরের ক্লাব ক্যারিয়ারে ৫৯৭টি ম্যাচে তাঁর গোলসংখ্যা ৯৭। তিনি
প্রথম ব্রিটিশ ফুটবলার হিসেবে চ্যাম্পিয়নস লিগে ১০০টি ম্যাচ খেলার কৃতিত্ব অর্জন করেন। আমি
ছোটবেলায় সৈনিক হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। আমি সৈনিকদের মতো মার্চ করে সারা বাড়ি কাঁপিয়ে
বেড়াতাম। তাঁদের মতো করে আমি কাদামাটিতে গড়াগড়ি করতাম। ছোটবেলা থেকেই আমার আকর্ষণ
ছিল ফুটবলের দিকে। ঘুম থেকে ওঠার পর ফুটবল সব সময় আমার সঙ্গে থাকত। এমনকি আমি স্কুলে
গেলেও ফুটবল হাতে করে নিয়ে যেতাম। আমার মনে আছে, আমি অনেকবার ফুটবল নিয়ে ঘুমিয়েও
গেছি।আশির দশকের শুরুর দিকের একটা স্মৃতি আমাকে বেশ নাড়া দেয়। আমরা থাকতাম দক্ষিণ-পূর্ব
লন্ডনের চিংফোর্ড এলাকায়। আমাদের বাড়ির পাশের মাঠের দেয়ালে একটি মাঝারি আকারের ছিদ্র
ছিল। আমি ও আমার বন্ধুরা দিনের আলো না নেভা পর্যন্ত সেই দেয়ালের ফুটো লক্ষ্য করে কিকের
পর কিক প্র্যাকটিস করতাম। মাঝেমধ্যে আমার বাবা টেড বেকহামও এই কিক-কিক খেলায় এসে যোগ
দিতেন।
ম্যানচেস্টার
ইউনাইটেডের হয়ে খেলতে পারাটা ছিল আমার ক্যারিয়ারে খুবই আনন্দের সময়। আমি সত্যিই
ভাগ্যবান। ম্যানইউ ছাড়া অন্য ক্লাবের হয়ে সেরা সব খেলোয়াড়ের সতীর্থ হিসেবে খেলেছি।
কিন্তু ম্যানইউ ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ। আমি ছোটবেলা থেকে যে ক্লাবের
হয়ে খেলার স্বপ্ন দেখতাম, সেই ক্লাবের হয়ে ১৩ বছর খেলেছি।
আমার
জীবনের অন্যতম সেরা খেলা ছিল ২০০১ সালে গ্রিসের বিরুদ্ধে। সে ম্যাচে আমি ৯৩ মিনিটে
অসাধারণ একটি কাজ করেছিলাম। সত্যি বলতে কি, সময়টি ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
মুহূর্ত। আমার দেশের জন্যও বিষয়টি ছিল সম্মানের। যদি ওই খেলায় জয়ী হই, তাহলে আমরা
বিশ্বকাপে খেলব। এমনই এক কঠিন সমীকরণের মধ্যে আমাদের বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন আটকে ছিল।
গ্রিসের বিরুদ্ধে মন-প্রাণ উজাড় করে খেলছিলাম। কিন্তু কিছুতেই যেন স্বপ্নের গোল দেখা
দিচ্ছিল না। আমি তো ১১ বার ফ্রি কিক নিয়েছিলাম, কিন্তু সবগুলোই গোলপোস্ট থেকে ফিরে
আসে। ৯৩ মিনিটের দিকে সহখেলোয়াড় টেডি শেরিংহ্যাম হঠাৎ করে বল নিয়ে মধ্যমাঠ পেরিয়ে
যায়। গোলপোস্টের সামনে গ্রিকদের প্রতিরোধ দেখে আমাকে বলটি পাস দিয়ে দেয়। আমি বল
পেয়েই গোলকিপারের মাথার ওপর দিয়ে গোলপোস্টে শট নিই। এটা ছিল আমার জীবনের প্রথম খেলা,
যেখানে আমি গোল করার পরে মাঠে হাঁটু গেড়ে কেঁদে ফেলি। আমার মা-বাবা স্টেডিয়ামে ছিলেন।
তাঁরাও কেঁদেছিলেন। পরে জেনেছি, শুধু আমিই নই, স্টেডিয়ামে থাকা কয়েক হাজার দর্শক,
সঙ্গে দেশের কোটি মানুষ সেদিন কেঁদেছিল। তাদের প্রতীক্ষিত স্বপ্ন পূরণে আমি সহায়তা
করি মাত্র।
আমি
বিশ্বাস করি, চর্চাতেই আত্মবিশ্বাস বাড়ে। আমি নিয়মিত ফুটবল প্র্যাকটিস করি। আমার
প্র্যাকটিস দেখে আমার সন্তানেরা অবাক হয়। তাদের বলি, যেহেতু আমি পেশাদার ফুটবলার,
তাই বেশি প্র্যাকটিস করি। সব সময় শুনতে হয়, আমি নাকি পৃথিবী সেরা মিডফিল্ডার। কিন্তু
ঈশ্বরের দোহাই, আমার থেকেও সেরা ফুটবলার অনেক দেখেছি।
আমি
মাঝেমধ্যে আমার ক্যারিয়ার নিয়ে চিন্তা করি। চোখ ফেরালে দেখি, সবকিছুই যেন সব সময়
আমার পক্ষে ছিল। টিম, ক্লাব, খেলোয়াড়, কোচ, ম্যানেজার, সমর্থক—সবাই।
সব
ক্রীড়াবিদের স্বপ্ন থাকে সাফল্যের সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠতে। ফুটবলার হিসেবে সবারই স্বপ্ন
থাকে সেরা হয়ে ট্রফি স্পর্শ করার। সব সময় সেই স্বপ্ন বাস্তবের মুখ দেখে না। কিন্তু
কেন জানি আমি সৌভাগ্যবান। আমি বেশ কয়েকটি টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন দলের হয়ে খেলে
ট্রফি স্পর্শ করার সুযোগ পেয়েছি। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, রিয়াল মাদ্রিদ, গ্যালাক্সি—সব
দলের হয়ে আমি চ্যাম্পিয়ন ট্রফি জেতার স্বাদ পাই।
আমার
ক্যারিয়ারের শেষ প্রান্তে এসে দেখতে পাই, আমি আমার দেশের জন্য ১১৫ বার মাঠে নামার
সুযোগ পেয়েছি। দুবার ফিফা বর্ষসেরা-রানারআপ ফুটবলার হয়েছি, তিনবার বিশ্বকাপ খেলার
সুযোগ পেয়েছি। দেশের জন্য বিশ্বকাপ জেতার আক্ষেপটা থেকে যাবে আমার। কিন্তু তার পরও
আমি নিজেকে নিয়ে খুশি।
আমি
সুপারস্টার হতে যুক্তরাষ্ট্রে যাইনি। আমি সেখানে একটি দলের হয়ে ফুটবল খেলতে গিয়েছি।
কঠিন পরিশ্রম করে সেই দলের হয়ে খেলায় জয়লাভের চেষ্টা করেছি। আমার সবকিছুই ফুটবলকে
ঘিরে। আমি সেখানে গিয়েছি পার্থক্য সৃষ্টির জন্য। আমি দাবি করিনি, আমার আগমনেই যুক্তরাষ্ট্রে
ফুটবল জনপ্রিয়তা পাবে। এটা অর্জন করা বেশ কষ্টকর হবে। বেসবল, বাস্কেটবলের ভিড়ে আমেরিকান
ফুটবলের জন্য তা সত্যিই কষ্টকর হবে।
আমি
সব সময় আমার দেশের প্রতিনিধি হওয়ার সুযোগ পেয়ে গর্বিত। বিশ্বকাপ হোক আর ইউরোপীয়
চ্যাম্পিয়নশিপ বা সামান্য কোনো প্রীতি ফুটবল ম্যাচ হোক না কেন, সব জায়গায় আমি দেশের
প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পেয়ে গর্বিত। দেশের জন্য কাজ করতে অত্যন্ত শ্রদ্ধাভরে অপেক্ষা
করি।
ব্রিটিশ
ম্যাগাজিন স্কয়ার (সেপ্টেম্বর, ২০১২) ও সিএনএন-এর (৩ এপ্রিল ২০১৩) সাক্ষাৎকার অবলম্বনে